একটি মানুষ
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
একটি মানুষ দেখেছিলাম, দাঁড়িয়েছিলেন একা
হঠাৎ পথে দেখা আমার, হঠাৎ পথে দেখা
সবাই তাঁকে দেখতে পায় না
সবাই তাঁকে দেখতে পায় না
কিন্তু, তিনি দেখেন–
কোথায় তোমার দুঃখ কষ্ট, কোথায় তোমার জ্বালা
আমায় বলো, আমারই ডালপালা
তোমার এবং তোমার, তুমি যেমন ভাবেই কাটো
আমি একটু বৃহৎ, তুমি ছোট্ট করেই ছাঁটো
লাগবে না লাগবে না
আমি কি আর পাথর, আমায় লাগবে একটুতে?
মানুষ আমি, কী মনে হয়? মানুষ সহ্য করে।
জিরাফের ভাষা ২৩
ভাস্কর চক্রবর্তী
এই রাত আর এই অন্ধকার তুমি তার মুখোমুখি একা।
শান্ত একটা হাওয়া আর রেডিয়ো চালিয়ে কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে।
যে জীবন পেলে তুমি কেমন লাগছে সে জীবন ?
কষ্টকর ? খুব একা ? খুব বেশি একা ?
যেখানে পায়ের ছাপ পড়ে দেখি সেখানেই রক্ত ফুটে ওঠে ।
বাংলা কমিক্স ~ অজানা দেশে | নারায়ণ দেবনাথ |
প্রীতিভোজ
জয় গোস্বামী
হেসো না দোয়েল, আমি বরাবর বাগানের লোক, আমি
নানারকমের কাজ জানি। যেমন এই, ঘাস তোলা বীজ রাখা
হাতে হাতে ফুলগাছ লাগানো, তুমি হেসো না দোয়েল আমি প্রথমদিনেই
তোমাকে চিনেছি গাছে বসবার সময় - কারণ আমি চিরকাল
গাছেদের লোক। এসবের মধ্যে আমি যাবো না ভেবেছিলাম, কিন্তু তুমি
প্রথমদিনেই বললে, 'আমাকে পছন্দ, মালী?' পছন্দ, পছন্দ। আর
কতবার ক'রে বলতে হবে আজ খুদকুঁড়ো যা পেয়েছি কুড়িয়ে বাড়িয়ে
যোগাড় করেছি তুমি চালেডালে যা হোক একটা কিছু শিগগির চাপিয়ে
দাও
আমি গিয়ে বন্ধুদের খেতে ব'লে আসি...
ছোট শিশুদের আদর দিয়ে শেখানো ঠাকুমার ছড়া
হাজার বর্ষ আগে
জীবনানন্দ দাশ
সেই মেয়েটি এর থেকে নিকটতর হ’লো না :
কেবল সে দূরের থেকে আমার দিকে একবার তাকালো
আমি বুঝলাম
চকিত হয়ে মাথা নোয়ালো সে
কিন্তু তবুও তার তাকাবার প্রয়োজন – সপ্রতিভ হয়ে
সাত-দিন আট-দিন ন-দিন দশ-দিন
সপ্রতিভ হয়ে — সপ্রতিভ হয়ে
সমস্ত চোখ দিয়ে আমাকে নির্দিষ্ট করে
অপেক্ষা করে — অপেক্ষা ক’রে
সেই মেয়েটি এর চেয়ে নিকটতর হ’লো না
কারণ, আমাদের জীবন পাখিদের মতো নয়
যদি হ’ত
সেই মাঘের নীল আকাশে
(আমি তাকে নিয়ে) একবার ধবলাটের সমুদ্রের দিকে চলতাম
গাঙশালিখের মতো আমরা দু’টিতে
আমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছি
তুমি কোন এক পাখির জীবনের জন্য অপেক্ষা করছো
হয়তো হাজার হাজার বছর পরে
মাঘের নীল আকাশে
সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাবো
আমাদের মনে হবে
হাজার হাজার বছর আগে আমরা এমন উড়ে যেতে চেয়েছিলাম।
ওই যে দুজন তোমরা
জয় গোস্বামী
ওই যে দুজন তোমরা থামের আড়ালে ঘন হয়ে
মেট্রো স্টেশনের মধ্যে ওই যে দুজন দাঁড়িয়েছ।
যে-মেয়েটি কথা বলছ ছেলেটির শার্টের বোতামে হাত রেখে
যে-ছেলেটি বান্ধবীর কপালের ঝুঁকে আসা ঢুল
সরাচ্ছ আঙুলে—তারা কদিন, কদিন পরে আর
শিক দিয়ে খন্তা দিয়ে এ অন্যের কয়লা ঘ্যাঁস চাপাপড়া মন
খুঁড়ে খুঁড়ে তুলবে না তো? প্রত্যাশার পচা হাড়গোড়
ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলবে না তো পাড়াপড়শি আত্মীয়বাড়িতে?
অভিযোগে অভিযোগে নোংরা ফেলে রাখবে না তো সমস্ত জায়গায়?
মেট্রো স্টেশনের মধ্যে ট্রেন ঢুকে পড়ল আর ট্রেন ছেড়ে যায়।
থামের আড়ালে তোমরা তেমনি দাঁড়িয়ে ঘন হয়ে
তোমাদের দেখে এক প্রেমভ্রষ্ট কবি আজ মিথ্যে এইসব ভয় পায়!
বাগানে কি ধরেছিলে হাত?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
যবে হাত ধরেছিলে হাতে
এ-প্রাণ ভরেছে অকস্মাতে
সকল বিস্ময়
তখনই তো ধ্বংসের সময়,
তখনই তো নির্মাণের জয়।
তোমার হাতের মাঝে আছে পর্যটন-
একথা কি খুশি করে মন?
একথা কি দেশ ঘুরে আসে
স্মরণীয় বসন্তবাতাসে!
এবার হলো না তবু ছুটি
দুলে ওঠে মোরগের ঝুঁটি
বেলা গেলো – বুকে রক্তপাত
বাগানে কি ধরেছিলে হাত
বাগানে কি ধরেছিলে হাত?
ছোট শিশুদের গল্প : হুলোর গলায় ঘন্টা , পাজি বাঘ
দেবীজন্ম
মন্দাক্রান্তা সেন
যে ছেলেটি আমার মনের মতো নয়
সে যদি আমার বুকে মাথা রাখে, বুক খসে যাবে ?
ভেবেছি অনেক বার, তবু, সে যখন কাছে আসে,
পাগলের মতো শুধু ছুঁতে চায় মুহূর্তের প্রেমে,
আমারও কেমন লাগে।
আমি জানি। এইসব কষ্ট জানি। ছোঁওয়া জানি।
ছুঁতে চেয়ে থেঁৎলে যাওয়া জানি।
যখন ঈষৎ দূরে বসে থাকে আমার মনের মতো ছেলে,
আমি তো এমনই করি,
মাথা খুঁড়ি পাথরে, শরীরে!
সে কবে আদর করবে, শুরু হবে মানুষ জন্মের
ততদিন---প্রেম নয়, আমি কোনও করুণার দেবী...
এই কি জীবন কালীদা
তারাপদ রায়
এসব কথা ভুলে যাওয়া যায় না,
মনে রাখাও সম্ভব নয়।
মাঠের ভিতরে উড়ে যাচ্ছে হলুদ রঙের পাতা, এলোমেলো অন্যমনস্ক পাখি,
বটগাছের নীচে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে শুয়ে আছে বংশবদ কুকুর,
রাস্তার কল থেকে আঁজলা করে
লোহার গন্ধমাখা জল খাচ্ছে ইস্কুলের ছেলেরা।
দূরে মেঘলা আকাশ নীল রঙের শীতের দিন,
যারা জঙ্গলে গিয়েছিলো একজন ছাড়া সবাই ফিরেছে,
যে ফেরেনি তার কথা আলোচনা করছে বাজারের লোকেরা,
তার বুড়ি ঠাকুমা দাওয়ায় বসে কাঁদছে,
চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে
একজন আরেকজনকে বলছে, এই কি জীবন, কালীদা?
এ সব ঠিক মনে রাখার বা ভুলে যাওয়ার নয়,
থাকে অথবা হারিয়ে যায়
কারোর কিছু আসে যায় না,
শুধু শুধু একা বৃদ্ধা দাওয়ায় বসে কাঁদে,
চায়ের দোকানে নিরুত্তর চুপচাপ বসে থাকে কালীদা।
দূরে মেঘলা আকাশ, নীল রঙের শীতের দিন।
বৈরাগীতলা
শঙ্খ ঘোষ
সেদিন কোথায় গিয়েছিলাম জানতে চেয়েছিলে
সহজ করে বলেছি বন্ধুকে---
গাঁয়ের নাম উজালডাঙা, সইয়ের নাম জবা
পথ গিয়েছে বৈরাগীদের বুকে।
শরীর থেকে শীতের বাকল শহর গেছে খুলে
মাথার উপর ছড়িয়ে গেছে হাঁস---
ঠিক তখনই সৌরধুলোয় অন্ধ, বলেছিলাম
এই গোধূলি অনন্তসন্ন্যাস!
অমনি সবাই প্রান্তে মিলায়, ঝাপসা রেখে আমায়
সঙ্গিনী যায় বৈরাগীগৌরবে---
দুহাত দিয়েই ধরেছিলাম, রইল না তো তবু
হাতেই কোনো ভুল ছিল কি তবে?
ছড়া অ থেকে চন্দ্রবিন্দু - ছড়া ও কবিতা
স্বপ্নের অন্তর্গত
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কারুর আসার কথা ছিল না
কেউ আসেনি
তবু কেন মন খারাপ হয়?
যে-কোনো শব্দ শুনেই
বাইরে উঠে যাই
কেউ নেই --
অদ্ভুত নির্জন হয়ে পৃথিবী
শুয়ে আছে
ঘুম ভাঙ্গার ঠিক আগের মুহূর্তের স্বপ্নে
আমিও যেন সেই স্বপ্নের অন্তর্গত।
১২ টি পেটে খিল ধরানো ভালো জোকস
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি সমস্ত জীবন ধ’রে
একটা বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটা গাছ জন্মাতে পারতাম
যেই গাছ ফুল হয়, ছায়া দেয়
যার ফুলে প্রজাপতি আসে, যার ফলে পাখিদের
ক্ষুধা মেটে ;
ছত্রিশ হাজার লাইন কবিতা না লিখে
যদি আমি মাটিকে জানতাম !
জন্মদিন
শঙ্খ ঘোষ
তোমার জন্মদিনে কী আর দেব এই কথাটুকু ছাড়া
আবার আমাদের দেখা হবে কখনো
দেখা হবে তুলসীতলায় দেখা হবে বাঁশের সাঁকোয়
দেখা হবে সুপুরি বনের কিনারে
আমরা ঘুরে বেড়াবো শহরের ভাঙা অ্যাসফল্টে অ্যাসফল্টে
গনগনে দুপুরে কিংবা অবিশ্বাসের রাতে
কিন্তু আমাদের ঘিরে থাকবে অদৃশ্য কত সুতনুকা হাওয়া
ওই তুলসী কিংবা সাঁকোর কিংবা সুপুরির
হাত তুলে নিয়ে বলব, এই তো, এইরকমই, শুধু
দু-একটা ব্যথা বাকি রয়ে গেল আজও
যাবার সময় হলে চোখের চাওয়ায় ভিজিয়ে নেবো চোখ
বুকের ওপর ছুঁয়ে যাবো আঙুলের একটি পালক
যেন আমাদের সামনে কোথাও কোনো অপঘাত নেই আর
মৃত্যু নেই দিগন্ত অবধি
তোমার জন্মদিনে কী আর দেবো শুধু এই কথাটুকু ছাড়া যে
কাল থেকে রোজই আমার জন্মদিন।
শিশুদের আনন্দের চাবিকাঠি সুকুমার রায়ের কবিতা
তা নইলে
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
কিছু পেলে কিছু দিয়ে দিবি,
তা নইলে পৃথিবী
চলতে-চলতে একদিন চলবে না।
আকাশে ঘনিয়ে আসবে ঘোর
অন্ধকার, তোর
ঘরে-বাইরে কেউ কথা বলবে না।
দরজায় লাগানো ছিল তালা,
বেলকুঁড়ির মালা
পড়ে ছিল রজ্জুর সমান।
লুণ্ঠন করেছ পুষ্প সব,
অথচ সৌরভ
এক-কণা করোনি কাউকে দান।
কিছু যত পাচ্ছে, প্রতিদিন
জমছে তত ঋণ।
একটু তার শোধ করো এবারে।
নইলে খসে পড়বেই ঘরবাড়ি,
সূর্য দেবে আড়ি
বিশ্ব ডুবে যাবে অন্ধকারে।