ছাত্রটির নাম চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলেরই ইংরেজির শিক্ষক গোপালচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলে।
চারুচন্দ্র কাছে এসে দাঁড়াল।
স্যার জিজ্ঞেস করলেন তোমাদের ক্লাসে একজন নতুন ছাত্র এসেছে.. আলাপ হয়েছে ?
- হ্যাঁ স্যার.. (ছাত্রের নাম গল্পের মধ্যে জানানো হচ্ছে )
- খাঁটি ছেলে।
- হ্যাঁ স্যার.. ইংরেজিতে বেশ স্ট্রং।
- তুমি তো ক্লাসে প্রথম হও .. তারপর হেসে বললেন, তোমার এবার একজন প্রতীদ্বন্দ্বী জুটল।
একটা অসাধারণ গল্প জেনে নেয়া যাক
র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল। ক্লাস সেভেন বা ফোর্থ ক্লাসের ঘর। ক্লাসে সংস্কৃতের শিক্ষক বিশ্বনাথ কাব্যতীর্থ পড়াচ্ছেন। সেইসময় স্কুলের প্রধানশিক্ষক বেণীমাধব দাশ একটি নতুন ছেলেকে সাথে করে ক্লাসে ঢুকলেন। 'এই ছেলেটি এই ক্লাসে আজ ভর্তি হল' - নতুন ছাত্রটিকে পৌঁছে দিয়েই ফিরে গেলেন প্রধানশিক্ষক মহাশয়। নতুন ছাত্রটি প্রথম বেঞ্চিতে ধীরেসুস্থে বসল। সংস্কৃতের শিক্ষক কাব্যতীর্থ মহাশয় চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন..
- তোমার নাম কী হে ?
নতুন ছাত্রটি উঠে দাঁড়িয়ে বললে
- শ্রী সুভাষচন্দ্র বসু।
- এর আগে কোন স্কুলে পড়তে ?
- প্রোটেস্টান্ট ইউরোপীয়ান স্কুলে।
- কী কী পড়তে সেখানে ?
- ল্যাটিন, ইংলিশ, ইংল্যাণ্ডস হিস্ট্রি, জিওগ্রাফি আর এরিথমেটিক।
জানুন: কে ছিলেন আর জী কর
নতুন ছাত্রটির ইংরেজি উচ্চারণ শুনে বাকি ছাত্ররা হকচকিয়ে গেল। শিক্ষক কাব্যতীর্থও একটু বিরক্ত.. রেগে গেলেন.. প্রশ্ন করলেন
- সংস্কৃত জানো ? শব্দরূপ ? নরঃ নরৌ নরাঃ ? আরে হাঁ করে আছো কী ! গৌ গাবৌ গাবঃ - জানো ?
মাথা নিচু করে নতুন ছাত্রটি বললে - জানি না।
- ধাতুরূপ ? গচ্ছতি গচ্ছতঃ গচ্ছন্তি - জানো ?
- জানি না।
রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের কবিতা : গানের জাল
- সংস্কৃত কতদূর জানো ? শিক্ষক কাব্যতীর্থ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ..
- কিছুই জানি না .. অক্ষর পরিচয়ও হয়নি। মাথা নিচু করেই বললে নতুন ছাত্রটি।
ক্লাসের সব ছাত্র হো হো করে হেসে উঠল। শিক্ষক কাব্যতীর্থ তাদের থামিয়ে আবার ঝাঁঝিয়ে প্রশ্ন করলেন - আর বাংলা ?
- বাংলাও ঐ স্কুলে পড়ান হত না।
- বলো কী! তোমার মাতৃভাষাও তোমাকে পড়ান হত না!
- না.. তারই জন্য তো ঐ স্কুল ছেড়ে এই স্কুলে ভর্তি হলাম।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিক্ষক কাব্যতীর্থ বললেন - ভাবছি.. তোমার কী দশা হবে!
- দু একদিনে শিখে নেব। শান্তমুখে বললে নতুন ছাত্র সুভাষচন্দ্র।
জানুন মূর্তিপূজা ও বিবেকানন্দের যুক্তি
হো-হো করে আবার হেসে উঠল ছাত্ররা .. যার বাংলা-সংস্কৃতে কোনও অক্ষর জ্ঞান পর্যন্ত নেই সে কিনা দু একদিনেই দিগগজ হবে !!
অসম্ভব রেগে গিয়ে শিক্ষক কাব্যতীর্থ মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠলেন.. এ্যাঁ.. দু একদিনেই শিখে নেব! .. কী দরকার ছিল এই স্কুলে ভর্তি হবার .. সাহেব স্কুলে সাহেব থাকলেই তো পারতে।
মাথা তুলে দীপ্ত মুখে নতুন ছাত্রটি বললে - বিশ্বাস করুন স্যার, দু একদিনে শিখে নেব।
এ অসম্ভবকে বিশ্বাস করা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। শিক্ষক কাব্যতীর্থ মহাশয়ও বিশ্বাস করলেন না.. তিনি আরো রেগে গিয়ে নতুন ছাত্রটির সামনে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললেন - ছাই শিখবে .. কিচ্ছু হবে না তোমার .. তোমার লেখাপড়া কিচ্ছু হবে না।
কিছু দিন পরে...
র্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলের প্রধানশিক্ষক বেণীমাধব দাশ স্কুলের ক্লাস চলাকালীন স্কুলের বারান্দা দিয়ে ঘুরে ঘুরে পায়চারি করে সব কিছু লক্ষ্য নজর করেন, এ তাঁর চিরাচরিত অভ্যাস। একদিন এমনই লক্ষ্য নজর রাখতে রাখতে একটি ছাত্রকে ডাক দিলেন ..
- ওহে চারু শোনো।
ছাত্রটির নাম চারুচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। এই স্কুলেরই ইংরেজির শিক্ষক গোপালচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলে।
চারু কাছে এসে দাঁড়াল।
- তোমাদের ক্লাসে একজন নতুন ছাত্র এসেছে.. আলাপ হয়েছে ?
- হ্যাঁ স্যার.. সুভাষ - সুভাষচন্দ্র বসু।
- খাঁটি ছেলে।
- হ্যাঁ স্যার.. ইংরেজিতে বেশ স্ট্রং।
- তুমি তো ক্লাসে প্রথম হও .. তারপর হেসে বললেন, তোমার এবার একজন প্রতীদ্বন্দ্বী জুটল।
- কিন্তু স্যার.. ও সংস্কৃত কিছুই জানে না.. আর বাংলাতেও খুব কাঁচা।
বেণীমাধব মহাশয় এবার একটু আনমোনা হয়ে গেলেন.. আকাশের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলে উঠলেন, শিখে ফেলবে .. দেখতে দেখতে শিখে ফেলবে .. যেমন বুদ্ধি তেমন মেধা .. ভেতরে স্থির শিখার সঙ্কল্পের আলো জ্বলছে।
বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের দিন...
বারান্দায় প্রধানশিক্ষক বেণীমাধব দাশ.. চারুকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন
- এবার বার্ষিক পরীক্ষায় তোমাদের ক্লাসে কে ফার্স্ট হল ?
- সুভাষ, স্যার।
- বলো কী ! সংস্কৃতে কত পেয়েছে ?
- একশোর মধ্যে একশো।
- বলো কী !! .. বেণীমাধব মহাশয় যত না বিস্মিত, মনে মনে তার থেকেও বেশি গর্বিত.. বললেন, একশোর মধ্যে একশো ! আর তুমি ?
চারু হেসে বললে, নিরানব্বুই।
এমন সময়ে দেখা গেল সংস্কৃতের শিক্ষক যাচ্ছেন, বেণীমাধব মহাশয় তাঁকে ডাকলেন। বিশ্বনাথ কাব্যতীর্থ কাছে এসে দাঁড়ালেন।
বেণীমাধব মহাশয় জিজ্ঞেস করলেন, সুভাষকে একশোর মধ্যে একশোই দিয়ে দিলেন !
কাব্যতীর্থ মহাশয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কী আর করব বলুন স্যার.. একশোর মধ্যে একশো দশ তো আর দেওয়া যায় না।
সুভাষচন্দ্র বসুর ছাত্র জীবনের এই ঘটনা আমরা সকলেই কম-বেশি জানি। কিন্তু এই ঘটনাটি যখন খুব গভীরভাবে ভাবি.. চিন্তা করি, এ কিভাবে সম্ভব.. অক্ষর জ্ঞান ছিল না.. তাও পরীক্ষার পরে দেখা গেল একশোয় একশো ! তারপরেই একটা অদ্ভুত মন-প্রাণ জুড়ানো ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল.. বুকের মধ্যে একটা গর্বের উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে .. এ যে সুভাষচন্দ্র বসু.. আমাদের নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। কোনও কিছুই অসম্ভব নয় তাঁর.. সেই ছোট্ট বয়স থেকেই। মা সরস্বতীর বরপুত্র তিনি।
তথ্যসূত্রঃ উদ্যতখড়্গ সুভাষ (৩-খণ্ড একত্রে) অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।