স্বামী সোমানন্দের রচনায় বিবেকানন্দের গল্প পুতুল পূজা I Vivekanander Golpo - Swami Somananda

পুতুল পূজা 

স্বামীজী চলেছেন ভারত পরিভ্রমণে। সঙ্গে একটি কোমণ্ডলু, একটি গেরুয়া বস্ত্র, একটি কম্বল, তিন চার খানা পুস্তক ও একটি লম্বা দণ্ড। নগ্নপদ, কিন্তু নির্ভীক বলিষ্ঠ তাঁর গতি।

উত্তরভারত পরিভ্রমণ তাঁর শেষ হয়েছে। এবার চলেছেন রাজস্থানের ভেতর দিয়ে পশ্চিম ভারতের দিকে। দিল্লী থেকে যাত্রা শুরু। তিনি নিঃসঙ্গ। গুরুভ্রাতারা সঙ্গে যাবার আবেদন করলেন। কিন্তু তিনি টা উপেক্ষা করলেন। তিনি সংকল্প করেছেন কারও কাছে কিছু চাইবেন না। অযাচিত ভাবে যা আসবে, তাই প্রয়োজন মতো গ্রহণ করবেন। কোন টাকা পয়সা সঙ্গে নেবেন না। কেউ স্বেচ্ছায় টিকিট কিনে দিলে গ্রহণ করবেন, নতুবা হেঁটেই চলবেন। তাঁর আরো সংকল্প - ভারতমাতা কে পরিপূর্ণ জানতে হবে, বুজতে হবে এবং ভারতের মর্ম বাণী কে অনুধাবন করতে হবে।

Swamiji tour at North India


দিল্লী থেকে ট্রেনে রওনা হয়ে একদিন সকালে তিনি আলোয়ার স্টেশনে নামলেন। তখন ১৮৯২ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। স্বামীজীর দৃপ্ত চেহারা, উজ্জ্বল চোখ সকলকেই আকৃষ্ট করে। শহরে যাওয়ার পথে এক ডাক্তার তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন এবং থাকবার ব্যবস্থা করে দিলেন।

শহরে একজন বড় সাধু এসেছেন, একথা শীঘ্র প্রচার হয়ে গেল। খবর শুনে প্রথমে একজন মৌলাবী এলেন। বিবেকানন্দের সঙ্গে কিছুক্ষন আলাপ করে তিনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মুসলমানী শাস্ত্রেও তাঁর পান্ডিত্য দেখে মৌলাবী অবাক হয়ে গেলেন। স্বামীজীর গভীর জ্ঞান ও ধর্মশাস্ত্রে অধিকার দেখে এবং বিচার ও বিতর্ক শুনে ক্রমে প্রচুর লোক - সমাগম হতে লাগল। তাঁকে পরে নিয়ে এলেন শহরের মাঝখানে এক বড় বাড়িতে, যাতে অধিক ব্যাক্তি তাঁর দর্শন ও শাস্ত্রের ব্যাখ্যা শুনতে পায়। এক একদিন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। শুধু খাওয়া ও ঘুমের সময় ছাড়া তিনি সর্বক্ষণ দর্শকদের ও জিজ্ঞাশুদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, নানা কথা বলছেন। কখনও সুমিষ্ট স্বরে ভক্তিমূলক গান শুনিয়ে সকলকে মুগ্ধ করছেন। তাঁর আগমনে আলোয়ার বাসীদের মধ্যে বিরাট এক আলোড়ন এল। আরও পড়ুন বীরবলের গল্প। 

ক্রমে আলোয়ার মহারাজের দেয়ানের কানে খবর গেল। তিনি স্বামীজীর দর্শনে সেখানে উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে নিজের বাড়িতে বহু সমাদরে নিয়ে এলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে দেয়ানজি বুঝলেন যে তিনি অনেক অসম্ভও সম্ভব করতে পারেন।

আলোয়ারের মহারাজা মঙ্গল সিংহ তখন রাজধানী থেকে কিছুদুরে প্রমোদ ভবনে ছিলেন। তিনি দেয়ানজীর কাছ থেকে খবর পেলেন যে একজন ইংরেজিতে পন্ডিত মস্ত বড় সাধু এসেছেন। খবর পেয়েই মহারাজ দেয়ানজীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন এবং স্বামীজী কে প্রণাম করে আসন গ্রহণ করলেন।

মহারাজ প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা স্বামীজী, আমি শুনেছি আপনি আদ্বিতীয় পন্ডিত। তা আপনি তো সহজেই অনেক টাকা উপার্জন করতে পারেন। তা না করে ভিক্ষা করে বেড়ান কেন?

স্বামীজী উত্তর করলেন, মহারাজ, আমিও আপনাকে জিজ্ঞেস করছি, আপনি রাজকার্য অবহেলা করে দিনরাত্রি সাহেবদের সঙ্গে খানা খেয়ে শিকার করে বেড়ান কেন?

সকলে স্বামীজীর কথা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠল। তিনি মহারাজ কে এমন দুঃসাহসিক প্রশ্ন করতে পারেন, কেউ চিন্তা করে নি। মহারাজ কিছুক্ষন চিন্তা করে বললেন, কেন আমি করি তা বলতে পারি না। তবে হ্যাঁ, ওরূপ করতে আমার ভাল লাগে তাই করি।

স্বামীজী হেসে বলে উঠলেন, আমারও এরকম ফকিরী করে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে, তাই করি।

কিছুক্ষন পরে মহারাজ আবার জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা স্বামীজী, সকলে যে মূর্তি পূজা করে, আমার তাতে মোটেই বিশ্বাস নেই, আমার কি দশা হবে?

একটু স্লেষের ভাব লক্ষ্য করে স্বামীজী বললেন, মহারাজ বোধহয় আমার সঙ্গে তামাশা করছেন।

- না, মোটেই নয়। মহারাজ বলতে লাগলেন, দেখুন, অন্যদের মত কাঠ, মাটি, পাথর, ধাতু এ সকল পূজা আমি করতে পারি না। এতে কি আমার পরের জন্মে নিচকুলে জন্মাতে হবে? 

- যার যেমন বিশ্বাস, এই বলে স্বামীজী চুপ করে গেলেন। তিনি ঘরের দেয়ালের দিকে তাকালেন এবং আলোয়ারের মহারাজের একটি ছবি দেখতে পেলেন। স্বামীজী একজন রাজকর্মচারীকে ছবিটি নামিয়ে আনতে বললেন। ছবিটি নিজের হাতে নিয়ে স্বামীজী জিজ্ঞেস করলেন, এটি কার ছবি।

দেয়ানজী উত্তর দিলেন, এটি মহারাজের ছবি।

হটাৎ স্বামীজী খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, দেয়ান জী, এ ছবির উপর থুতু ফেলুন।

সকলে ভয়ে শিউরে উঠল - সাধুজী বলেন কি! কিন্তু সকলেই ধীর নিশ্চল। দেয়ানজী চুপ। স্বামীজী আবার গভীর কন্ঠে বললেন, আপনারা যে কেউ এর উপর থুতু ফেলুন।

Swamiji proved the Murti Puja the religious faith befor Alowar Maharaja


কিন্ত কেউ এগিয়ে এলেন না। সকলে ভীত, ত্রস্ত, কি - জানি কি - হয় ভেবে আকুল। স্বামীজী আবার বললেন, এতে ভয়ের কি আছে? এতো একখানা কাগজমাত্র। এতে থুতু ফেলতে কি আপত্তি ?

দেয়ানজী ভয়ে ভয়ে বললেন, স্বামীজী, আপনি একি আদেশ করছেন ? এ যে মহারাজের প্রতিকৃতি। এঁর প্রতি আমরা কি ভাবে অসম্মান প্রদর্শন করি ?

স্বামীজী বললেন, কেন, মহারাজ তো আর সশরীরে এই ছবিতে নেই। এতে তাঁর হাড়, মাংস, রক্ত কিছুই নেই। এতো এক টুকরো কাগজ মাত্র। এর উপর থুতু ফেলতে ভয়ের কি আছে?

সবাই চুপ। ভীতিজনক নিস্তব্ধতা বিরাজমান। স্বামীজী নিজেই এবার উত্তর দিলেন, জানি আপনারা কেউ এ ছবিতে থুতু ফেলতে পারবেন না। কারণ এ ছবিতে মহারাজের সাদৃশ্য রয়েছে, মহারাজের ছায়া এখানে দেখা যাচ্ছে। এর উপর থুতু ফেলতে গেলে মনে হবে যেন মহারাজের গায়েই থুতু ফেলছি।

সকলে হাঁফ ছেড়ে সমস্বরে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, তাই বটে।

স্বামীজী এবার মহারাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, মহারাজ, দেখুন, যদিও এই ছবিটি আপনি নন, এক টুকরো কাগজ মাত্র, তথাপি আপনার সভাসদবর্গ এটিকে ঠিক আপনার মতোই ভাবেন। কারণ এতে আপনার প্রতিবিম্ব রয়েছে। সুতরাং এক হিসাবে এই চিত্রের সঙ্গে আপনার কোন প্রভেদ নেই। এর দিকে তাকালেই মনে হয় যেন আপনি স্বয়ং ওখানে আছেন। সেজন্যে সকলে আপনার মত এই ছবি কেও সম্মান করে।

একটু থেমে স্বামীজী বললেন, ভগবানের ভক্ত দেবদেবীর মূর্তিকে এইভাবেই দেখেন। ভক্ত কখনও পাথর কাঠ বা ধাতুদ্রব্যকে পূজা করেন না। তার মধ্যে যে ঈশ্বর আছেন তাঁরই পূজা করেন। মূর্তিটি তাঁর মনে আরাধ্য দেবতার স্মৃতি ফুটিয়ে তোলে। অথবা ভগবানের কোন গুনের কথা স্মরণ করে তিনি সেইভাবে ভাবিত হন। ইহা পুতুল পূজা নয় - প্রতীক উপাসনা। মূর্তিপুজক কখনও বলেন না, হে প্রস্তর, আমি তোমার উপাসনা করি। হে ধাতু, আমার প্রতি সদয় হও। পাষান বা ধাতু মূর্তি দেখলে ভক্তের তাঁর ইস্টকেই মনে পরে এবং এজন্যই তিনি মূর্তিকে সন্মান করেন।

মহারাজা এতক্ষন একাগ্রচিত্তে স্বামীজীর কথা শুনছিলেন। তিনি করজোড়ে নিবেদন করলেন, স্বামীজী, আমি এতদিন অন্ধ ছিলাম। কিছু বুঝতে পারি নি - আপনার দয়ায় আজ আমার চোখ খুলল।

আরও : শিশুদের জন্য অনেক কবিতার তালিকা 


2 মন্তব্যসমূহ

নবীনতর পূর্বতন